📖দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের একমাত্র মহিলা সুলতান ছিলেন রাজিয়া।দাস বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান ইলতুৎমিস মৃত্যুর পূর্বে তাঁর কন্যা রাজিয়াকে সুলতান হিসাবে মনোনীত করেন। কিন্তু ইলতুৎমিসের মৃত্যুর দিল্লির গোঁড়া উলেমা ও আমির-ওমরাহরা তার পুত্র রুকনউদ্দিন ফিরোজকে দিল্লির সিংহাসনে বসান।
📖রাজিয়ার সিংহাসনে আরোহন-উলেমা এবং আমির-ওমরাহদের অনুগ্রহে রুকনউদ্দিন ফিরোজ দিল্লির সিংহাসনে বসলেও অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর অযোগ্যতা ও অপদার্থতায় আমির-ওমরাহদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তাঁরা রুকনউদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনচ্যুত করে 1236 খ্রীঃ রাজিয়াকে দিল্লির সিংহাসনে বসান।
📖বিদ্রোহ দমন-সিংহাসনে আরোহন করেই রাজিয়া বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও রাজিয়া বিরোধী চল্লিশ চক্রের অন্যতম নেতা মালিক মহম্মদ জুনাইদি রাজিয়ার সিংহাসন লাভের বিরোধিতা করতে থাকেন। রাজিয়ার ব্যক্তিত্ব ও তুর্কি অভিজাতদের একাধিপত্য খর্ব করার প্রচেষ্টায় তুর্কি অভিজাতরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। মুলতান, লাহোর, বদায়ুন, হানসি প্রদেশের আঞ্চলিক শাসনকর্তারা দিল্লি অবরোধ করে রাজিয়ার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলেন। এইরূপ সংকটময় পরিস্থিতিতে রাজিয়া সুস্থ মস্তিষ্কে সমস্যা সমাধানের দিকে অগ্রসর হন। তিনি সুকৌশলে বিভিন্ন বিদ্রোহী আমির ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন এবং বিরোধী পক্ষের মহম্মদ সালারি, ইজ্জুদিন, কবির খান প্রমুখকে নিজপক্ষে আনতে সক্ষম হন।মালিক মহম্মদ জুনাইদি পলাতক অবস্থায় নিহত হন। ঐতিহাসিক মিনহাজ উস সিরাজের মতে, বাংলা থেকে সিন্ধু পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সকল আমির ও প্রাদেশিক শাসকগণ রাজিয়ার বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। এভাবে রাজিয়া নিজের সিংহাসন কণ্টকমুক্ত করেন।
📖প্রশাসনিক পদক্ষেপ-শাসনকার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে রাজিয়া একটি অনুগত গোষ্ঠী তৈরি করার উদ্যোগ নেন। তুর্কি অভিজাতদের দ্বারা গঠিত চল্লিশ চক্র ভেঙে দিয়ে তিনি একটি কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। প্রশাসনের বিভিন্ন উচ্চপদে অতুর্কি মুসলমানদের বসিয়ে তিনি তুর্কি অভিজাতদের ধ্বংস করার চেষ্টা করেন।তিনি মুহজাবউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং কুতুবউদ্দিন হাসান ঘুরিকে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ করেন।রাজিয়ার এইসব তুর্কি বিরোধী প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে তুর্কি অভিজাতরা রাজিয়ার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এবং রাজিয়া বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
📖রাজকীয় মনোভাব-এক মধ্যযুগীয় মহিলা হওয়া সত্বেও রাজিয়া সুলতানের মতো দৃষ্টিভঙ্গিতে চলাফেরা করতেন। অন্দরমহল থেকে তিনি যখন রাজসভায় অথবা প্রজাদের সামনে আসতেন তখন পুরুষের মতো পোশাক পরিধান করতেন। পুরুষের পোশাকে সজ্জিত হয়ে নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে ঘোড়ার পিঠে চড়ে তিনি সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করতেন।এছাড়া তিনি সুলতানদের মত তাঁর মুদ্রায় ইমদৎউল নিশান বা প্রতিভাময়ী মহিলা-এই শব্দগুলি খোদাই করেছিলেন। রাজিয়ার এই সমস্ত রাজকীয় কার্যকলাপ দিল্লির উলেমা ও মৌলভীদের ক্ষুব্ধ করে।তাঁরা রাজিয়াকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
📖আলতুনিয়ার বিদ্রোহ-দিল্লির আমির-ওমরাহ ও অভিজাতরা রাজিয়াকে সিংহাসন চ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলে রাজিয়া সেই সমস্ত ষড়যন্ত্রকারীদের দমন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু অভিজাতদের নেতা বলবন ও রাজপরিবারের প্রধান কর্মচারী আইতিগিনের সহায়তায় ভাতিন্দার শাসনকর্তা ইখতিয়ার উদ্দিন আলতুনিয়া রাজিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাজিয়া তাঁর সেনাপতি জামাল উদ্দিন ইয়াকুৎ খাঁকে সঙ্গে নিয়ে ভাতিন্ডা দুর্গ অভিযান করেন। কিন্তু ইয়াকুৎ খাঁ যুদ্ধে নিহত হন এবং আলতুনিয়ার হাতে রাজিয়া বন্দি হন।
📖মৃত্যু-আলতুনিয়ার হাতে রাজিয়া বন্দি হলে তার ভাই বাহরাম শাহ দিল্লির সিংহাসনে বসেন।কিন্তু আলতুনিয়াকে কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ না দেওয়ায় আলতুনিয়া ক্ষুব্ধ হন।আলতুনিয়ার এই ক্ষোভের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজিয়া আলতুনিয়াকে বিবাহ করে দিল্লীর সিংহাসন পুনর্দখলের চেষ্টা করেন এবং দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু বাহারাম শাহের বাহিনীর কাছে তাঁরা পরাজিত হয়ে ভাতিন্দায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।পথিমধ্যে সুলতানি বাহিনীর হাতে 1240 খ্রীঃ আলতুনিয়া ও রাজিয়া উভয়েই নিহত হন।
📖মূল্যায়ন-রাজিয়ার রাজ্য পরিচালনা ও তাঁর কৃতিত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেছেন। তাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী রাজিয়া ছিলেন শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী, শিশ্প-সাহিত্যের অনুরাগী ও বিদ্যোৎসাহিনী।সুলতান হিসাবেও তিনি ছিলেন দয়ালু, ন্যায় পরায়ণা, প্রজাবৎসলা ও সমরকুশলা।মধ্যযুগের একজন নারী হয়েও তার স্বল্পকালের রাজত্বকালে তিনি যে শাসন দক্ষতা, ন্যায় পরায়ণতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও মানবিক অনুভূতির পরিচয় দিয়েছেন তা এককথায় অনবদ্য। ঐতিহাসিক ড. এ. কে. নিজামির মতে, “ইলতুৎমিশের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ”। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তবের মতে, “She was the first Turkish ruler of Delhi to have imposed the royal will upon the armies and Malik”.